সকালের কফি—গুজব ও বিজ্ঞান

সকালের কফি—অনেকের দিনের প্রথম সঙ্গী। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে: “কফি ডায়াবেটিস বাড়ায় কি?” আসুন সরলভাবে শুরু করি — কফি ও ডায়াবেটিস সম্পর্কিত প্রচলিত গুজবের পেছনের বিজ্ঞানটা অনেকটা ভিন্ন। বাংলাদেশ ও ভারতের শহরাঞ্চলে এই অনুভূতিটি বেশি, কারণ এখানে ডায়াবেটিসের হার বাড়ছে এবং লোকের মধ্যে ভুল তথ্য দ্রুত ছড়ায়।

শুরুতেই সাফ জবাব: মহাপর্যায়িক গবেষণা জানায়, কালো কফি নিয়মিত পরিমিতভাবে পেলে টাইপ ২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমায় — কিন্তু এই সত্যের দুইটা শর্ত আছে: কফি যেন বেশি চিনি বা ক্রিমার-মিশ্রিত না হয়, এবং ব্যবহার পরিমিত (সাধারণত দিনে ২–৪ কাপ)। ২০১৮ সালের কয়েকটি বড় মেটা-অ্যানালাইসিস এই পয়েন্টগুলোর উপরই জোর দিয়েছে। ২০১৮ সালের একটি বিশ্লেষণে দেখা গেছে নিয়মিত কফি পান টাইপ ২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি প্রায় ৩০% পর্যন্ত কমাতে পারে। (বিস্তারিত গবেষণা সূত্র পরে দেয়া আছে)।

লিড: কেন মানুষ ভ্রান্ত ধারনা পায়?

প্রধান কারণটি হলো কফিতে থাকা ক্যাফেইন-এর স্বল্পমেয়াদী প্রভাব। কেউ কখনো খালি পেটে সকালের কফি পান করে রক্তে শর্করার পরীক্ষা করলে সাময়িকভাবে বাড়া দেখতে পারে — এবং সেই এক বা দুই পরীক্ষার ভিত্তিতেই ধারণা গড়ে ওঠে যে “কফি ডায়াবেটিস বাড়ায়”। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদী পর্যবেক্ষণ বলছে অন্য কথা: কফির মধ্যে যেসব অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও পলিফেনল (যেমন ক্লোরোজেনিক অ্যাসিড) আছে, সেগুলো সময়ের সাথে শরীরের বিপাকীয় ও ইনসুলিন সংবেদনশীলতাকে ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে।

পটভূমি: গবেষণা কি বলছে?

কফি ও টাইপ-২ ডায়াবেটিস সম্পর্কিত বহু বড় গবেষণা থেকে ধারাবাহিক প্রমাণ মেলেছে। বিভিন্ন দেশ ও জনগোষ্ঠীতে করা মেটা-অ্যানালাইসিসে দেখা গেছে: প্রতিদিন কফি পানের পরিমাণ বাড়লেই ডায়াবেটিস ঝুঁকি কমার প্রবণতা দেখা যায় — এটা ডোজ-নাপেক্ষ (dose-dependent) সম্পর্কের ইঙ্গিত দেয়। ক্যাফেইনযুক্ত এবং ডিক্যাফ—উভয় রকম কফির সুরক্ষা চিহ্ন দেখা গেছে, ফলে কেবল ক্যাফেইন নয়, বরং কফির অন্যান্য জৈব-সক্রিয় যৌগগুলোর ভূমিকা বেশি। সিঙ্গাপুরের এশিয়ান জনগোষ্ঠীর উপর করা একটি অধ্যয়নে প্রতিদিন ৪ কাপ বা তার বেশী কফি পেলে প্রায় ৩০% ঝুঁকি হ্রাস পাওয়া যায়।

কফির ভেতরের জিনিসপত্র: কেন উপকারী?

কফি অনেকগুলো যৌগের মিশ্রণ। এতে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, পলিফেনল, ক্লোরোজেনিক অ্যাসিড, এবং কিছু খনিজ (যেমন ম্যাগনেসিয়াম) আছে। এগুলো মিলে কাজ করে—

  • ইনসুলিন সংবেদনশীলতা বাড়ায়;
  • অন্ত্র থেকে শর্করা শোষণ ধীর করে;
  • প্রদাহ কমায়;
  • এবং যকৃতের গ্লুকোজ উৎপাদন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।

ক্যাফেইন-পার্ট: স্বল্পমেয়াদী বিভ্রান্তি

ক্যাফেইন খালি পেটে গ্রহণ করলে সাময়িকভাবে কর্টিসল ও অ্যাড্রেনালিন বাড়িয়ে রক্তে গ্লুকোজে সাময়িক স্পাইক ঘটাতে পারে। কিন্তু নিয়মিত কফিপানের ফলে শরীরের সহনশীলতা তৈরি হয় এবং কফির অন্য উপকরণের দীর্ঘমেয়াদী সুবিধা এই ক্ষণিকের প্রভাবকে ছাপিয়ে যায়। তাই একেকটি ছোট পরীক্ষার ফলাফলকে মোট সিদ্ধান্ত মনে করলে ভুল হবে।

কফি পান করার ধরনটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ

উত্তরটা সহজ: কফি নিজে নয়, কফির সাথে কী যোগ করছেন— সেটাই সমস্যার মূল। বাংলাদেশ ও ভারতের শহরে কফে-ক্যাফে সংস্কৃতির সঙ্গে চিনি, সিরাপ, হোয়িপড ক্রিম ও ফ্লেভার-সিরাপের প্রবেশ বাড়ছে। এক কাপ ফ্লেভারড ল্যাটে বা মিষ্টিযুক্ত ফ্র্যাপ্পে চিনি ও ক্রিমের কারণে ক্যালরি ও শর্করার পরিমাণ এমনভাবে বেড়ে যায় যে কফির ন্যহিত্য উপকারিতা নিপাত হয়। উদাহরণসরূপ: সাধারণ কালো কফির ক্যালরি প্রায় ৫–১০ kcal; কিন্তু চিনিযুক্ত ল্যাটে বা ফ্লেভারড কফিতে ৮৮–১৫০ kcal বা তারও বেশি হতে পারে। (বাংলাদেশে এক কাপ কফির খরচ সাধারণত প্রায় ৩০–১০০ টাকা; শহরের বড় ক্যাফে‌তে দাম বেশি)।

যে সকল প্রতিষ্ঠান ও বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলছে

আমেরিকান ডায়াবেটিস অ্যাসোসিয়েশনও পরামর্শ দেয় যে, উচ্চ-শর্করাযুক্ত পানীয় এড়ানো উচিত। অনেক ডাক্তারের পরামর্শ: ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের প্রথমে নিজে নিজে পর্যবেক্ষণ করা জরুরি—কফি পান করার আগে ও পরে গ্লুকোজ পরীক্ষা করে দেখুন। এছাড়া, কফির সাথে যোগ করা চিনির বদলে ডিক্যাফ বা কালো কফি চয়ন করা ভালো হতে পারে।

কফির কাপ
ছবি: কফির পদের একটি উদাহরণ — মনে রাখুন, কফির ধরন ও সঙ্গে যোগ করা উপাদানই বেশি মনে রাখার বিষয়।

ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য ব্যবহারিক নির্দেশিকা (সারসংক্ষেপ)

করণীয়: কালো কফি বা ডিক্যাফ নির্বাচন করুন; দিনে ২–৪ কাপ পরিমিত রাখুন; খাবারের সঙ্গে কফি খান; নিজের রক্তশর্করা মনিটর করুন; চিকিৎসকের সাথে আলোচনা করুন।

বর্জনীয়: চিনিযুক্ত বা ক্রিমারযুক্ত কফি প্রতিরোধ করুন; খালি পেটে বড় পরিমাণ কফি পান করবেন না; রাতে বেশি কফি পান না (ঘুম বিঘ্নিত করে)।

ভারত-বাংলাদেশ প্রসঙ্গ: মিথ ছড়ানোর কারণ

এই অঞ্চলে গুজব ছড়ানোর পেছনে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও শিক্ষাগত কারণ আছে। বহু মানুষ আয়ুর্বেদিক বা লোকচিকিৎসার সূত্রে এবং সামাজিক মিডিয়ায় অপ্রমাণিত তথ্য দেখে সিদ্ধান্ত নেন। তবে নগরায়ণের সঙ্গে কফি-সংস্কৃতি দ্রুত বাড়ছে এবং খালি-চিনি/সিরাপ মিশিয়ে খাওয়া ইউনিটগুলি ডায়াবেটিস ঝুঁকি বাড়াচ্ছে—এটাই প্রকৃত সমস্যা।

উপসংহার: কফি—শতা ভাগ উপকারী, দশ ভাগ সাবধান

সারমর্ম: বৈজ্ঞানিক প্রমাণ বলছে, পরিমিত কফি পানে টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমতে পারে। কিন্তু খেয়াল রাখুন: কী দিচ্ছেন কফির সঙ্গে, কখন খাচ্ছেন, এবং আপনার ব্যক্তিগত শারীরিক অবস্থা কী—এসবই শেষ সিদ্ধান্ত নির্ধারণ করবে। প্রতিটি ব্যক্তির রেসপন্স আলাদা হতে পারে; তাই ডায়াবেটিস থাকলে নিজের রক্ত-চিনি পর্যবেক্ষণ করে এবং চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে কফি অভ্যাস ঠিক করুন।